শীতের সংক্রমণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
নগর খবর ডেস্ক : ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে শীত, কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল যেন সন্ধ্যা। ষড়ঋতুর দেশে শীত নানা মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয় যার প্রভাব পড়ে আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
দেশের বিভিন্ন জেলায় এখন শীতের প্রকোপ বেড়েছে। উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা দিনাজপুর। ২ জানুয়ারি সকাল ৬টায় দিনাজপুরে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এই সময় বাতাসে আর্দ্রতা ছিল ৯৫ ভাগ। এটি জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এছাড়া মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছে আবহাওয়াবিদরা।
শীতে একদিকে তাপমাত্রা কমে, অন্যদিকে বৃষ্টিপাত কমে মাঠঘাট শুকিয়ে ধূলিধুসরিত হয় প্রকৃতি। বাড়ে রোগের সংক্রমণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি। বায়ু দূষণ বাড়তে থাকে, চোখে ছানি পড়ার মতো দৃষ্টি সীমায় স্থির হয়ে থাকে কুয়াশা আর ধোঁয়ার সমন্বয়ে তৈরি অস্বস্তিকর স্মোক।
শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য শীতকাল বিভীষিকার মতো আর বায়ু দূষণের শীর্ষ নগরী ঢাকায় স্মোক তাদের জন্য আক্ষরিক অর্থেই বিভীষিকা। বায়ু দূষণের জন্য সম্প্রতি বেশ কয়েকদিন ভারতের দিল্লিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়। তবে ঢাকার বায়ুমানও দিল্লির কাছাকাছি দূষিত, দিল্লি ১ম হলে ঢাকা পঞ্চম।
শুধু ঢাকা নয় বাংলাদেশের বায়ুমান তেমন কোনোখানেই খুব আশাব্যঞ্জক নয়, ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার দূষণও যেমন টেক্কা দেয় বহু নগরকে। বায়ু দূষণকে এত প্রাধান্য দেওয়ার কারণ হচ্ছে শ্বাসকষ্ট বা দীর্ঘস্থায়ী অবরোধক ফুসফুসীয় ব্যাধি বা সিওপিডি (Chronic Obstructive Pulmonary Disease-COPD)-এর বাড়বাড়ন্তের খবর।
সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও শ্বাসকষ্ট বাড়ছে, তাতে মৃত্যু আনুপাতিক হারে বাড়ছে। অসংক্রামক প্রধান চারটি রোগের একটি সিওপিডি। বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের ১২.৫ শতাংশ জনগণ সিওপিডিতে ভুগছে।
বিশ্বে ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত মৃত্যু প্রায় ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মনে রাখতে হবে যে শুধু বাইরের বায়ু দূষণ নয় ঘরের ভেতরের বায়ু দূষণও শ্বাসকষ্ট এবং তার কারণে মৃত্যুর জন্য সমানভাবে দায়ী।
রান্নায় কমবেশি সব রান্নাঘরের বায়ু দূষিত হয়, তবে জ্বালানি ব্যবহারের ওপর বায়ু দূষণের মাত্রা নির্ভর করে। গ্রামের রান্নাঘরে ব্যবহৃত বেশিরভাগ জ্বালানি অধিক দূষণ করে থাকে।
শীতকালে শুধু অসংক্রামক রোগ বা শ্বাসকষ্ট হয় তা নয়, অন্যান্য আরও নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে থাকে এবং তাতে মৃত্যুও হয়। এগুলোর মধ্যে শ্বাসনালির সংক্রমণ, শৈত্যপ্রবাহজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যু, বাহকজনিত রোগ, অপুষ্টি, ডায়রিয়া অন্যতম।
শীতকালে নানা ধরনের শ্বাসনালির সংক্রমণ হয়ে থাকে। একদিকে যেমন ঊর্ধ্ব শ্বাসনালির সংক্রমণ হয় তেমনি নিম্ননালির সংক্রমণ বা নানা ধরনের নিউমোনিয়া হয়ে থাকে। এই নিউমোনিয়া নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসে সংঘটিত হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে মহামারি আকারে নবজাতকদের মধ্যে নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে।
রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস (RSV) ও নিউমোনিয়াতে প্রতি বছর বেশ বড় সংখ্যক নবজাতক এবং বয়স্ক মানুষ মৃত্যবরণ করে। করোনার নতুন ধরন জেএন১ (JN1) আবার বিশ্ব প্রেক্ষাপটে দেশের মধ্যেও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। এখন বিশ্বে যত করোনা হচ্ছে তার প্রায় ৪৪ শতাংশই এই নতুন ধরন দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে এবং ২০২৩ সালের নভেম্বরের তুলনায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তা ৮ গুণ বেড়ে গেছে।
আমাদের দেশে করোনার মূল প্রাদুর্ভাব ঘটে গ্রীষ্মকালে সুতরাং আমাদের করোনা প্রতিরোধে প্রস্তুতি কার্যক্রম শুরু করা দরকার, যাতে এই রোগ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা রাখা যায়।
২০২৩ সালে ডেঙ্গু সারা দেশে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩২১০৭৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং ১৭০৩ জন মৃত্যুবরণ করেছে, যা ২০০০ সাল থেকে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যুকে ছাড়িয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যেসব চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হয় তাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে ভূমিকা তাতে সন্দেহের জায়গায় রয়ে গেছে। তার সমাধান আর হয়নি। তবে ২০২৪ সাল আমাদের জন্য নিরাপদ হোক এখন সেইটাই কামনা।
অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; প্রাক্তন পরিচালক, রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর