গৃহায়ণের জমি দখল করে এশিউর গ্রুপের ফ্ল্যাট
নিউজ ডেস্ক : রাজধানীর মিরপুর ৯ নম্বরের বাউনিয়া মৌজায় প্রায় ১৬৮ একর জমির মালিক জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ (জাগৃক)। ১৯৬৮ সালে অধিগ্রহণ করা এ জমিতে ১৯৯৫ সালে একনেক থেকে একটি প্রকল্প পাস হয়। সেখানে সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস নামের একটি প্লট উন্নয়ন প্রকল্পের আংশিক কাজও সম্পন্ন হয়। সরকারের গেজেটভুক্ত বিশাল এই এলাকার প্রায় দুই একর (৬ বিঘা) জমি দখলে নিয়েছে এশিউর গ্রুপ নামের বেসরকারি আবাসনপ্রতিষ্ঠান। সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রির আয়োজনও করেছে তারা।
৬ বিঘা জমিতে রাজউকের বিধি মেনে একগুচ্ছ ১০ তলা ভবন করলে অন্তত ৪ লাখ ৩২ হাজার বর্গফুট বিক্রয়যোগ্য আয়তন পাবে এশিউর গ্রুপ। সে হিসাবে নিজেদের ঘোষিত মূল্য প্রতি বর্গফুট সাড়ে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটির পকেটে আসতে যাচ্ছে কমপক্ষে ৫৪০ কোটি টাকা। এ দখল ঠেকাতে সরকারের জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত এক শর বেশি সাধারণ ডায়েরি এবং একাধিক ফৌজদারি মামলা করেছে। তবে দখলের কাজটি নির্বিঘ্ন করতে এশিউর কর্তৃপক্ষ কৌশলে সামনে রেখেছে সাবেক কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা-আমলা ও বিহারি ক্যাম্পের লোকজনকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৬৮ সালে প্রথম দফায় মিরপুরের বাউনিয়া মৌজায় ১৬৮ একর জমি অধিগ্রহণ করে ঢাকার জেলা প্রশাসন। এ জমিতে সরকারি অর্থে জাগৃক ‘সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস’ নামের একটি প্রকল্পের কাজও করে। কিন্তু বিশাল এ জমি সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে বেহাত হতে থাকে। একপর্যায়ে সাগুফতা হাউজিং নামের একটি স্থানীয় ভূমি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জুয়েল মোল্লা কমবেশি ১২ একর জমি দখলে নেন। জুয়েল মোল্লা সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লাহর ভাতিজা। একপর্যায়ে তিনি নিজের দখলদারি পাকাপোক্ত করতে সাবেক সামরিক ও বেসামরিক কয়েকজন আমলাকে নামমাত্র মূল্যে জমি লিখে দেন। ওই কর্মকর্তারাই একসময় এশিউর গ্রুপের কাছে তাঁদের জমির মালিকানা হস্তান্তর করেন। ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটি তাঁদের সামনে রেখেই নিজেদের ‘এশিউর ঢাকা স্কয়ার’ নামের প্রকল্পে ফ্ল্যাট তৈরির কাজ এগিয়ে নেয়।
জাগৃকের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, বাউনিয়া মৌজায় সিএস ৩১২৪ দাগে ১৪ দশমিক ৫৮ একর জমির একটি গেজেট প্রকাশিত হয়। সেখানে অধিগ্রহণ করা এলএ কেস নম্বর-১৩ /৫৯-৬০ নিয়ে ১৯৮০ সালের ১৮ ডিসেম্বর একটি, এলএ কেস ৯০/৬৫-৬৬ নিয়ে ১৯৭০ সালের ২৯ জানুয়ারিতে একটি এবং এলএ কেস ৫/৭২-৭৩ নিয়ে ১৯৭৪ সালের ১০ অক্টোবর মোট তিনটি গেজেট প্রকাশিত হয়। এসব গেজেটের পর ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ১৯৯০, ২০১৫ এবং সর্বশেষ ২০২০ সালের ৫ মার্চ জাগৃকের অনুকূলে জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এশিউর গ্রুপের দখলে নেওয়া এরই একটি অংশে পড়েছে। যে জমিতে এশিউর ভবন নির্মাণ করছে, সেখানে জাগৃকের মিরপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলীর প্রস্তাব অনুযায়ী সরকারের মডেল মসজিদ হওয়ার কথা ছিল।
এশিউর গ্রুপের এ প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক (সেলস) কার্তিক চন্দ্র সাহা বলেন, এ প্রকল্পে মোট ৬ বিঘা জমি রয়েছে। তা ফ্ল্যাট নির্মাণের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতি বর্গফুটের দাম কমবেশি সাড়ে ১২ হাজার টাকা।
সরকারি জমি দখল হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাগৃকের চেয়ারম্যান মো. হামিদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এসব জমি গেজেটভুক্ত। তারা (এশিউর) দাবি করলেই মালিক হতে পারবে না। আমরা এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
একই কথা বলেন সংস্থাটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হারিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘যে জমি এসিউর বা অন্যরা নিজেদের দাবি করছে, তা আমাদের অধিগ্রহণ করা জমি। তিনবার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জাগৃকের কাছে এর দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয়।’
আজকের পত্রিকার হাতে আসা ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকারি জমি দখলে সাবেক সচিব, সামরিক কর্মকর্তাদের পরিচয়কে ব্যবহার করা হচ্ছে। আশপাশে থাকা বিহারি ক্যাম্পের লোকজনকেও কাজে লাগানো হচ্ছে। জাগৃকের নিজের ‘স্বপ্ননগর’ প্রকল্পের ২৩ ও ১১ নম্বর ভবনের মধ্যবর্তী স্থানে ৬০ ফুট রাস্তা ও এবং প্রকল্প-২ এর সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে আরও কিছু জমি অবৈধ দখল হয়েছে। সর্বশেষ গত ৩০ আগস্ট সেখানে এশিউর গ্রুপ সীমানাপ্রাচীর তৈরি করে আনসার ক্যাম্প বসিয়েছে বলে জানা যায়। একই দিনে ভবন নম্বর ১২-এর উত্তর পাশে সরকারের চলমান প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয় কোম্পানিটির লোকজন। এরপর গৃহায়ণের উপসহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, জাগৃক তার নিজস্ব প্রকল্পের সীমানায় ১৩ সেপ্টেম্বর নির্মাণকাজ শুরু করার পর বহিরাগত লোকজন সেখানে হামলা চালায়। এতে নেতৃত্ব দেন এশিউর ডেভেলপারের পক্ষে উজ্জ্বল এবং ফারুক নামের দুই ব্যক্তি। তাঁদের সঙ্গে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বিহারি ক্যাম্পের লোকজনও ছিল। মাস দুয়েক ধরে পাল্টাপাল্টি দখলের একপর্যায়ে জাগৃক ও দখলদারদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। সেখানে সরকারি সংস্থাটির আইন কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান ও সাবেক এক প্রকৌশলীকে ৬ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার দাবি করেছেন দখলদারেরা। তবে এই অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি আইন কর্মকর্তা আসাদুজ্জামানের।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এশিউর গ্রুপের চেয়ারম্যান শেখ সাদী বলেন, ‘এখানে মোট ৯০ শতাংশ জমি নিয়েছি। জমির কাগজপত্র সব দেখে ঠিকঠাক মনে হয়েছে। কিছু সাবেক কর্মকর্তা এ জমি সাগুফতা হাউজিংয়ের কাছ থেকে কিনেছেন। কোনো সমস্যা তো মনে হলো না।’