শত সিসিটিভি ফুটেজেও শনাক্ত হয়নি খুনি কারা!


নগর খবর ডেস্ক : রাজধানীর গোলাপশাহ মাজারের কাছে গত বছরের ২৮ জুলাই আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ শেষে সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে ৬টার দিকে সংঘর্ষে জড়ায় কেরানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপ। সেসময় এলোপাথাড়ি কোপানো হয় পাঁচজনকে। তাদের মধ্যে হাসপাতালে মারা যান হাফেজ রেজাউল করিম।
ঘটনার ছয়মাস অতিবাহিত হলেও খুনিদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনার আশপাশের শত সিটিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি ডিবি পুলিশ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, শত সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হলেও স্পষ্টত হাফেজ রেজাউলকে কোপানোর ফুটেজ মেলেনি। সেদিন দলীয় শান্তি সমাবেশ শেষে ফেরার পথে আকস্মিক সংঘর্ষে জড়ায় আওয়ামী লীগেরই ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য কামরুল ইসলাম এবং কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের সমর্থকরা। বিভিন্ন সময়ে দুই গ্রুপের চারজনকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও কেউ জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি।
যদিও ঘটনার পর একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী গণমাধ্যম ও পুলিশকে জানিয়েছিলেন, গত ২৮ জুলাই আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ শেষে নেতাকর্মীরা যখন ফিরে যাচ্ছিলেন, তখনই ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য কামরুল ইসলাম এবং কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের সমর্থকরা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও এক দলকে সশস্ত্র অবস্থায় এলোপাথাড়ি যাকে তাকে কোপাতে দেখাতে যায়।
শান্তি সমাবেশে যোগ দিতে এসে সংঘর্ষে জড়ানো অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপই নিশ্চিত করেছে— সেদিন সংঘর্ষের মধ্যেই কুপিয়ে হত্যা করা হয় হাফেজ রেজাউল করিমকে। তবে দুই পক্ষের অভিযোগ বিপরীতমুখী। একে অপর গ্রুপের উপর দায় চাপিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।
গত ২৮ জুলাই(শুক্রবার) বিএনপির মহাসমাবেশের পালটা কর্মসূচি হিসেবে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইটে শান্তি সমাবেশ করে আওয়ামী লীগের তিন সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ। শান্তি সমাবেশ শেষে ফেরার সময় সংঘর্ষে জড়ায় ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য কামরুল ইসলাম এবং কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের সমর্থকরা। এ সময় রাস্তায় থাকা নেতাকর্মীরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। একপর্যায়ে এক পক্ষের ধাওয়ায় অন্য পক্ষ সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের দিকে চলে যায়। সংঘর্ষের পর পাঁচজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) নেওয়া হলে চিকিৎসক রেজাউলকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত মো. আরিফুল (১৮), জোবায়ের (১৮), রনি (৩২) ও মোবাশ্বেরকে(২৮) হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
ঘটনার পর নিহতের বড় বোন ফারহানা আফরিন সুমি পুলিশের সহযোগিতায় পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতদের। এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে— সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পল্টন মডেল থানাধীন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের পশ্চিম প্রান্তে পাকা রাস্তার উপর পথচারী লোকজনদের মধ্যে মারামারি ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয় এবং কয়েকজন লোক আহত হয়। কিছুক্ষণ পর ঘটনার জের ধরে গোলাপশাহ মাজারের আশপাশে পুনরায় অবৈধ জনতাবদ্ধে মারামারি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এর মাঝখানে পড়ে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারীদের এলোপাথাড়ি ছুরিকাঘাতে হাফেজ রেজাউলসহ কয়েকজন পথচারী গুরুতর আহত হয়।
মামলায় ও পুলিশের সুরতহালে উল্লেখ করা হয়েছে, দুষ্কৃতিকারীদের ছুরির আঘাতে হাফেজ রেজাউলের বাম পায়ে গুরুতর জখমপ্রাপ্ত হয় এবং প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।
পরিবার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিহত রেজাউল করিম(২১) যাত্রাবাড়ী জামিয়া ইসলামীয়া দারুল উলুম মাদ্রাসায় (বড় মাদ্রাসা) দাওরাহ হাদিসে অধ্যায়নরত। শেরপুরের নকলা উপজেলার নারায়নকোটা গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে হাফেজ রেজাউল। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে বড় তিনি।
ঘটনার পর মরদেহ নিতে এসে ঢামেক হাসপাতাল মর্গের সামনে রেজাউলের চাচা আজহারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, শেরপুরের একটি মাদ্রাসা থেকে হাফেজি পাস করে গত দুই বছর যাবত রেজাউল জামেয়া মাদানিয়াতে পড়াশুনা করছিল। গত কুরবানির ঈদের আগে ডেঙ্গু জ্বরে বিছানায় পড়ে রেজাউল। বাধ্য হয়ে সে মাদ্রাসা ছেড়ে বাড়ি চলে আসে। বাড়িতে এসে আবার জন্ডিসে আক্রান্ত হয়। অনেকদিন বাড়িতে চিকিৎসার পর গত সপ্তাহে ঢাকায় যায় রেজাউল।
তিনি বলেন, ওর সহপাঠীরা বলছে— শুক্রবার বিকেলে মাদ্রাসা থেকে ওষুধ কেনার উদ্দেশ্যে নাকি বের হয়েছিল রেজাউল। অথচ পুলিশ ফোন করে পরদিন রেজাউলের নৃশংস মৃত্যুর খবর দিয়েছে।
ছয় মাসেও রেজাউল হত্যার কূলকিনারা পায়নি ডিবি
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সেদিন সংঘর্ষে জড়ানো দুই গ্রুপকে আগে শনাক্তে কাজ শুরু করে ডিবি পুলিশ। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়— কমলা রঙের ও হলুদ রঙের ক্যাপ পড়া নেতাকর্মীরা সেদিন সংঘর্ষে জড়িয়েছিল। খোঁজ নিয়ে ও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ডিবি পুলিশ জানতে পারে— কমলা রঙের ক্যাপ পড়া ছিল কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের সমর্থকরা। আর হলুদ রঙের ক্যাপ পড়া ছিল ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য কামরুল ইসলামের সমর্থকরা।
এরপর হাফেজ রেজাউল হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে দুই গ্রুপের দুজন করে মোট চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে গত ৯ আগস্ট কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে মো. মিরাজ তালুকদার(৩২) ও মো. সোলায়মান ওরফে সালমান(৩৬), ১৭ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে থেকে মো. আলী হোসেন(৪৫) ও বিদেশ গমনের আগে বিমানবন্দর এলাকা থেকে গত ১৪ অক্টোবর পারভেজ হোসেন বিপ্লবকে (৩১) গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতে সোপর্দ করে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও কেউ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি।
সূত্র আরও জানায়, আওয়ামী লীগ পার্টি অফিস থেকে শুরু করে গোলাপশাহ মাজার ও এর আশপাশের এলাকার শত সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কিন্তু স্পষ্ট কোপাকুপির কোনো ফুটেজ মেলেনি। দৌড়াদৌড়ি দেখা গেছে। যে কারণে এখনো স্পষ্ট নয়, কে বা কারা কুপিয়ে খুন করেছে হাফেজ রেজাউলকে।
গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার(ডিসি) রাজিব আল মাসুদ গণমাধ্যমে বলেন, সংঘর্ষে জড়ানো দুই গ্রুপকে আমরা শনাক্ত করেছি ক্যাপ পড়া দেখে। এরপর চারজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কিন্তু কারো মুখ থেকে বের হয়নি স্বীকারোক্তি।
তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি খুনিদের শনাক্ত করার জন্য। তবে এখন পর্যন্ত আমরা কিনারা করতে পারিনি। তদন্ত শেষ হলে আমরা আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেব।
আজসহ (শুক্রবার) ছাড়াও গত এক সপ্তাহে বাদীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
তবে এর আগে গত বছরের ৩ আগস্ট মোবাইল ফোনে নিহত রেজাউলের বোন ও মামলার বাদী ফারহানা আফরিন সুমী ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, রেজাউল একদম ঝামেলামুক্ত ছেলে। কোনো রাজনীতি করত না। অনেকদিন ধরে ভাইটা অসুস্থ ছিল। ঢাকা গিয়ে ভাইটা আমার খুন হলো। পুলিশ এতো এতো আসামি ধরে, চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী ধরে আমার ভাইটার খুনি কারা? সেটা বের করতে পারে না?
রেজাউলকে যারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন তিনি।