নিরাপত্তা পরিষদের কর্তৃত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা ব্যাপক ক্ষুণ্ন হয়েছে
নগর খবর ডেস্ক : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলি আগ্রাসন চলছে টানা দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে। ইসরায়েলি বর্বর এই আগ্রাসনে বিপুল সংখ্যক নারী ও শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ বাড়লেও যুদ্ধবিরতি কার্যকর বা সংঘাত নিরসন বা বেসামরিক হতাহত বন্ধে জাতিসংঘের ব্যর্থতা চোখে পড়ার মতো।
এছাড়া যুদ্ধবিরতির চেষ্টায় জাতিসংঘে উত্থাপিত একটি প্রস্তাবও ভেটো দিয়ে বাতিল করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কর্তৃত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সংস্থাটির প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস।
এমনকি গাজার সংঘাত নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের নীরবতার সমালোচনাও করেন তিনি। সোমবার (১১ ডিসেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা সংঘাত ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং কর্তৃত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রোববার জানিয়েছেন।
গাজায় মানবিক সহায়তার আহ্বান জানিয়ে ইতোপূর্বে জাতিসংঘের পাস করা একটি প্রস্তাব সম্পর্কে গুতেরেস বলেন, ‘বিলম্বের জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে। নিরাপত্তা পরিষদের কর্তৃত্ব এবং বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং রেজল্যুশনটি বাস্তবায়িত হচ্ছে না।’
কাতারে অনুষ্ঠিত দোহা ফোরামে বক্তৃতাকালে গাজা সংঘাতের বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ‘আলোড়ন-সৃষ্টিকারী নীরবতার’ সমালোচনা করেন আন্তোনিও গুতেরেস।
তিনি বলেন, ‘গত ৭ অক্টোবর হামাসের ভয়ঙ্কর আক্রমণ এবং এরপর থেকে গাজায় ইসরায়েলি নিরলস বোমাবর্ষণের ঘটনায় নিরাপত্তা পরিষদ নীরব ছিল। এর এক মাসেরও বেশি সময় পরে কাউন্সিল অবশেষে একটি রেজুলেশন পাস করে। যেটাকে আমি স্বাগত জানিয়েছলাম।’
তবে রেজোলিউশনটি বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে এসময় দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি। গুতেরেস জোর দিয়ে বলেন, ‘গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের জন্য কোনও কার্যকর সুরক্ষা নেই।’
প্রসঙ্গত, গত ৭ অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন আন্তঃসীমান্ত হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।
মাঝে হামাসের সাথে এক সপ্তাহব্যাপী মানবিক বিরতির পর গাজা উপত্যকায় পুনরায় বিমান ও স্থল হামলা শুরু করে ইসরায়েল। বিরতির পর শুরু হওয়া এই অভিযানে গাজায় হামলা আরও তীব্র করেছে দখলদার সেনারা।
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করার পর থেকে সেখানে কমপক্ষে ১৮ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত এবং আরও প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন।
নিহত এসব ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কমপক্ষে ৭ হাজার ১১২ জন শিশু এবং ৪ হাজার ৮৮৫ জন নারী রয়েছেন। এছাড়া ভূখণ্ডটিতে এখনও প্রায় ৭ হাজার ৬০০ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
রোববার দোহায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়ও গাজার দক্ষিণে লড়াই অব্যাহত ছিল। আর ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের মধ্যেই গাজা উপত্যকায় আবারও মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান জাতিসংঘের এই মহাসচিব।
গুতেরেস বলেন, ‘এতো অল্প সময়ের মধ্যে গাজায় বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা সম্পূর্ণ নজিরবিহীন। গাজার স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে।’
এমনকি জাতিসংঘের এই মহসচিবের আশঙ্কা, ‘গাজায় জনশৃঙ্খলা শিগগিরই সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়বে এবং তারপরে আরও খারাপ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। যার মধ্যে মহামারি রোগ এবং মিসরে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির চাপ বৃদ্ধির মতো বিষয়ও রয়েছে।’
আর তাই গাজায় ‘মানবিক বিপর্যয় এড়াতে চাপ দেওয়ার’ জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে আহ্বান জানান গুতেরেস। এসময় তিনি ‘মানবিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আবেদনও’ পুনর্ব্যক্ত করেন।
তার ভাষায়, ‘দুঃখজনকভাবে, নিরাপত্তা পরিষদ এটি (যুদ্ধবিরতি কার্যকর) করতে ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু এতে করে এটি কম প্রয়োজনীয় কোনও বিষয় হয়ে যায় না। তাই আমি প্রতিশ্রুতি দিতে পারি যে, আমি হাল ছেড়ে দেবো না।’
উল্লেখ্য, গাজায় অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় দ্বিতীয় দফা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি উত্থাপন করে অস্থায়ী সদস্য সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)।
সেই প্রস্তাবে উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি দু’টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছিল আমিরাত। প্রথমত, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সব বেসামরিক লোকজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, অবিলম্বে ও শর্তহীনভাবে সব বন্দিকে মুক্ত করতে হবে।
শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে প্রস্তাবটি পেশ করার পর সেটি গৃহীত হয় এবং সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ভোটের জন্য উত্থাপন করা হয়। ভোটে পরিষদের স্থায়ী-অস্থায়ী ১৫ সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ১৩টিই এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
বাদ ছিল কেবল দুই স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাজ্য ভোটদান থেকে বিরত থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে সরাসরি আপত্তি বা ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এতে করে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়।