f
রাজশাহী

মাত্র সাত মাস এমপি থেকে সম্পদে টইটম্বুর কালামের ভান্ডার

মেয়র থেকে এমপি হয়ে সাত মাসেই গড়েছেন অনেক সম্পদ, নামে বেনামে হাজার কোটি টাকার মালিক

রাজশাহীর তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র থেকে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের এমপি ছিলেন মাত্র সাত মাস। আর তাতেই ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন আবুল কালাম আজাদ! এমনই অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এই এমপির বিরুদ্ধে। অনেকেই বলছেন, তার সম্পদ বেড়েছে রকেটের গতিতে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র থাকাকালীনই আবুল কালাম আজাদ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ও দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে সম্পদ গড়া শুরু করেন। পরে গত সংসদ নির্বাচনে তিনবারের এমপি এনামুল হককে টেক্কা দিয়ে দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে এমপি হওয়ার পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

এমপি হয়ে সাত মাসেই সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে ওই উপজেলায় প্রায় ৫০০ বিঘা জমি ও পুকুর দখল করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু নিজে নয়, অবৈধ সম্পদ অর্জনে তাহেরপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র স্ত্রী শায়লা পারভীনকেও করেছেন সঙ্গী।

অনুসন্ধানে আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিশাল ফিরিস্তি পাওয়া গেছে। জানা যায়, বাগমারার তাহেরপুর সুপার মার্কেটের জায়গা দখল করে সেটি বিক্রি করে প্রকৃত জমির মালিককে না দিয়ে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে নেন অন্তত ৫ কোটি টাকা। জায়গাটি ছিল হরিজন (সুইপার) পল্লীর লোকদের আবাসস্থল। তাদের সেখান থেকে অবৈধভাবে উচ্ছেদ করলেও অন্যত্র পুনর্বাসন করা হয়নি। সরকারি খাদ্য গোডাউন ভেঙে সেখানে মার্কেট নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন ছিল। তবে মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দেওয়ার নাম করে বহু মানুষের থেকে অন্তত ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। তাহেরপুর পৌর এলাকার হরিতলা মোড়ে সড়ক বিভাগের জায়গা দখলে নিয়ে মার্কেট নির্মাণ করে সেখানে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মার্কেটে কে কে (কালাম-কোস্তরী) ফ্যাশন হাউস নামে একটি শোরুম নিজের মালিকানায় করেছেন তিনি। তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজের সামনে শতাধিক দোকানঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে ভাড়া। তবে ভাড়া ও দোকান বরাদ্দের অর্থ কখনো পৌরসভার অ্যাকাউন্টে জমা হয়নি বলে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজের সামনে শিক্ষক কোয়ার্টার দখল করে নির্মাণ করেছেন ভবন। তাহেরপুর ভূমি অফিসের জায়গা ও পাশের পুকুর দখলে নিয়ে তা ভরাট করে গড়ছেন একটি তিন তলা বাড়ি!
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, এমপি হয়েই বাগমারা এলাকায় অন্তত ৫ হাজার বিঘা ফসলি জমি দখলে নিয়ে শুরু করেন মাছ চাষ। এ প্রজেক্ট থেকে হাতিয়ে নেন অন্তত ৪০০ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে তাহেরপুর পৌর এলাকার বাসিন্দারা জানান, কালাম মেয়র থাকা অবস্থায় তাহেরপুর বাজারে অন্তত ৮ কোটি টাকা মূল্যের একটি জমির দখল নেন। জায়গাটি তাহেরপুর মন্দিরের নামে থাকলেও মেয়র থাকাকালীন তা দখল করে গড়েন পাঁচ তলা মার্কেট। পৌরসভার রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বিভিন্ন উন্নয়নকাজের ঠিকাদারি মূলত সহযোগীদের লাইসেন্সে তিনি নিজেই করতেন। এভাবে তিন মেয়াদে মেয়র থাকাকালে শুধু পৌরসভা থেকেই ঠিকাদারি ও দুর্নীতির মাধ্যমে অন্তত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এভাবে সব মিলিয়ে অবৈধভাবে কালাম এখন অন্তত হাজার কোটি টাকার মালিক।

জানা গেছে, নিজ নামে আবুল কালামের একটি দোতলা আলিশান বাড়ি আছে। রাজশাহী শহরের বড় বনগ্রাম এলাকায় আছে ১০ কাঠা জমি। রাজশাহী নগরীর পদ্মা আবাসিক এলাকা এবং ঢাকায় আছে তার একাধিক ফ্ল্যাট। নিজের মালিকানায় আছে ২০০ বিঘা আয়তনের ৩০টি পুকুর। এ ছাড়া ইজারা নিয়ে প্রায় ৫০০ বিঘা আকারের পুকুরে করেন মাছ চাষ। এসবের মূল্য ৫০ কোটি টাকার মতো। গ্রামে কিনেছেন ৪০ বিঘা জমি। চলাচলও করেন দেড় কোটি টাকা মূল্যের টয়োটা কোম্পানির ল্যান্ড ক্রুজার ব্র্যান্ডের গাড়িতে। আছে আরও দুটি বিলাসবহুল প্রাইভেট কার।

ক্ষমতার অপব্যবহার ও সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আবুল কালাম আজাদের সম্পদের পাহাড় প্রসঙ্গে তাহেরপুর এলাকার কল্যাণ কুমার নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার জমি বলতে কিছু নেই। ৫ শতক জমির ওপর শুধু পৈতৃক বাড়ি-ভিটা। সেটি আমার নিজের নামেই আছে ৪০ বছর ধরে। এরপর হঠাৎ শুনি সেই জমি আর আমার নামে নেই, কালামের (এমপি) নামে হয়ে গেছে। ৪০ বছর থেকে ভোগ-দখল করে আসা বাড়ি-ভিটা কোনো কারণ ছাড়াই দখল করে নেওয়ায় অনেক কষ্ট পেয়েছি। কারও কাছে গিয়ে কোনো বিচার পাইনি। বেদখল হয়ে যাওয়া সেই বাড়ি-ভিটার কাগজ নিয়ে আমি এখন পথে পথে ঘুরছি। আমি কোনো মামলা করতে চাই না, শুধু আমার বাড়ি-ভিটা ফেরত চাই।’

হরিজন সম্প্রদায়ের সৌর বালা নামে এক বৃদ্ধা বলেন, ‘ব্রিটিশ আমল থেকে আমরা ৮-১০টি পরিবার হরিজন পল্লীতে একই সঙ্গে ছিলাম। ২০১৮ সালে পৌর মেয়র থাকাকালে কালাম আমাদের বাড়িঘর উচ্ছেদ করে সেখানে সুপার মার্কেট নির্মাণ করে। আমাদের কোথাও পুনর্বাসনও করা হয়নি। তখন থেকেই আমরা রাস্তার পাশে ড্রেনের ওপর ময়লা-আবর্জনার মধ্যে বসবাস করছি।’ এদিকে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই পলাতক আছেন আবুল কালাম আজাদ ও তার স্ত্রী তাহেরপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র শায়লা পারভীন। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপডেট আছেন দুজনেই। নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে চেয়ে শায়লা পারভীনকে মেসেজ করা হলেও কোনো উত্তর দেননি।

Source
বাংলাদেশ প্রতিদিন
Back to top button