সারাদেশ

৯ বছর ধরে বন্ধ রেডিওথেরাপি, ভোগান্তিতে ক্যান্সার রোগীরা

নগর খবর ডেস্ক : এক হাজার শয্যাবিশিষ্ট ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার জন্য একমাত্র রেডিওথেরাপি মেশিনটি বিকল হয়ে পড়ে আছে। প্রায় নয় বছর ধরে মেশিনটি বন্ধ থাকায় রেডিওথেরাপি নিতে পারছেন না এ অঞ্চলের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা। তাদের অতিরিক্ত টাকা খরচ করে ঢাকায় গিয়ে রেডিওথেরাপি নিতে হচ্ছে। এতে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন তারা।

জানা গেছে, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০২৩ সালে অন্তত ২২০০ ক্যান্সার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। ২০২২ সালে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২ হাজারেরও বেশি। গত ২০২১ সালে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেয় প্রায় ১৯০০ ক্যান্সার রোগী। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ফুসফুস, স্তন ও পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যাই বেশি। প্রতিবছরই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ রোগীর সংখ্যা বেশি।

রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার জন্য রয়েছে ৯ শয্যা বিশিষ্ট একটি ডে কেয়ার সেন্টার। বিশেষায়িত কোনো ইউনিট না থাকায় মেডিসিন, সার্জারি, গাইনী ওয়ার্ডে ক্যান্সার রোগীদের রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয় হাসপাতালটিতে।

কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার চৌগাঙ্গা ইউনিয়নের বাদুতিকান্দা গ্রামের বাসিন্দা কৃষক মো. সুলতান। ৫০ বছর বয়সী এই কৃষক ২০২২ সাল থেকে পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত। চিকিৎসায় ইতোমধ্যে ৬ লাখ টাকা খরচ করে তিনি নিঃস্ব এখন। সম্প্রতি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডে কেয়ার সেন্টারে কেমোথেরাপী নেওয়া সুলতানের সঙ্গে কথা হয়।

হতাশার সুরে তিনি বলেন, এইডাই আমার জীবনের শেষ চিকিৎসা। আর যেন না আওন লাগে হাসপাতালে। দুই বছরে নিজের জমি বেইচ্যা, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থাইক্যা আইন্যা ৬ লাখ টাকার মতো খরচ করছি। অহন আর কারো কাছে হাত পাততে পারতাম না। হাসপাতালে দৌঁড়াইতে দৌঁড়াইতে সব টেহা শেষ। এখন ঘরে পইর‍্যা মরাম।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালের ১০ নভেম্বর কোবাল্ট সিক্সটি রেডিওথেরাপি মেশিনটি চালু করা হয় মমেক হাসপাতালে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত এটি সচল ছিল। বিকল হওয়ার পর রেডিওথেরাপি মেশিনটি মেরামত করে সচল করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে পত্র দেওয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়া বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতালের নির্মাণকাজ গত বছরের মাঝামাঝিতে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ধীরগতির কাজের কারণে শেষ হতে আরও কয়েক বছর লাগতে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

জানা গেছে, সরকারিভাবে টুজি রেডিওথেরাপির খরচ হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। সেটি বেসরকারিভাবে করলে খরচ হয় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। আর থ্রিজি রেডিওথেরাপি করা হলে সরকারিভাবে খরচ ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা এবং বেসরকারিভাবে করলে খরচ হয় দেড় লাখ টাকা। মমেক হাসপাতালে রেডিওথেরাপি বাদে অন্য চিকিৎসা চললেও দরিদ্র ক্যান্সার রোগীদের রেডিওথেরাপী নিতে ছুটতে হয় ঢাকায়। অনেক রোগীর পক্ষে ঢাকায় গিয়ে রেডিওথেরাপী নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সাইফুল ইসলাম পাঠান বলেন, ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার অন্যতম অনুষজ্ঞ রেডিওথেরারি। এর মাধ্যমে রোগীদের যন্ত্রণা উপশম করা হয়। সার্জারি, কেমোথেরাপিসহ অন্যসব চিকিৎসা চললেও রেডিওথেরাপির জন্য রোগীদের ঢাকায় পাঠাতে হচ্ছে। অনেক সময় খরচের কথা চিন্তা করে গরিব রোগীরা ঢাকায় যায় না।

হাসপাতালে রেডিওথেরাপি চালু থাকলে ক্যান্সার রোগীদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা এখানেই হতো।

ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণকাজে ধীরগতি

ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ চত্বরে চলছে ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণকাজ। নামে ক্যান্সার হাসপাতাল হলেও নেফ্রোলজি ও ডায়ালাইসিস ইউনিট এবং কার্ডিয়াক ইউনিটও থাকছে একই ভবনে। প্রকল্প এলাকায় সাঁটানো সাইনবোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ভবনের বেইজমেন্টের দ্বিতীয় তলা থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত হবে ক্যান্সার ইউনিট। অষ্টম তলা থেকে এগারো তলা পর্যন্ত নেফ্রোলজি ও ডায়লাইসিস ইউনিট এবং বারো থেকে পনেরো তলা পর্যন্ত কার্ডিয়াক ইউনিট। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের (স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের) কাজটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর।

চট্টগ্রামের দেশ উন্নয়ন লিমিটেড নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ক্যান্সার হাসপাতালটির নির্মাণকাজের দায়িত্ব পায়। প্রায় ৮৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে কাজটি পায় তারা। যদিও সরকারের প্রাক্কলিত মূল্য ধরা ছিল ৯৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ২৪ মাসের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার সময় বেঁধে দিয়ে ২০২১ সালের ৬ জুন প্রকল্প এলাকা বুঝিয়ে দেওয়া হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৩ সালে ৫ জুন ক্যান্সার হাসপাতালটি নির্মাণকাজ সমাপ্তির কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে মাত্র পাঁচতলা পর্যন্ত হয়েছে নির্মাণকাজ। প্রকল্পটির সময় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে কিছু বিষয় যুক্ত হওয়ায় আরও ১০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় বাড়িয়ে সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

নির্মাণকাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত অধিপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী শামীম আল মামুন বলেন, কাজের গতি কম থাকলেও তা বাড়াতে তাগাদা দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের সময় বাড়ানোরও প্রস্তাব অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। দ্রুত যেন কাজটি শেষ হয় সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. জাকিউল ইসলাম বলেন, রেডিওথেরাপি মেশিনটি বিকল হওয়ার পর থেকে তা মেরামত করে সচল করার জন্য চিঠি পাঠানো হলেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। নতুন একটি ক্যান্সার ইউনিট হচ্ছে। সেখানে দুটি আধুনিক লিনিয়র এক্সিলারেটর মেশিন স্থাপন করা হবে। দ্রুত সেটির নির্মাণকাজ শেষ হলে এ এলাকার ক্যান্সার রোগীরা উপকৃত হবেন।

Back to top button